ঘটনা ২০০৯ সনের। দুরু দুরু বুকে আমরা কয়জন বিপ্লবী হইয়া চিঠি লিখলাম পাঠশালায়। গুরুজনদের ব্যর্থতা সামনেই ছিল, ভয়টাও তাই ছিল বেশী। বড়দের থেকে শিক্ষা নিয়া আমরা সেইজন্য অসম্ভব কূটনৈতিক ভাষা ব্যবহার করলাম। ধরি মাছ, না ছুঁই পানি–র ঐ চিঠির ফলাফল যে এত ব্যপক হবে বুঝিনাই তখনো। আজকে ২০১৬ সালের এই দিনে আইসা বোধয় বুঝি খানিকটা, যখন চারপাশে তাকাই। কত কিছু বদলাইসে, তবে পাঠশালা অন্তত আমাদের কাসে কৃতজ্ঞ থাকবে ঐ চিঠির জন্য, এইটা নিশ্চিত।
যাইহোক ঐ চিঠির পর আমরা একজন আনকোরা শিক্ষক পাইলাম। যার passion নিয়া তর্ক ছিলনা, কিন্তু ‘ব্যবহার’ নিয়া গল্প চালু ছিল অনেক। (মজার ব্যপার হইল, সেইসব গল্প চালু আছে এখনো। প্রত্যেক batch তার পরের batch রে কয়, মিয়া তোমরা আর দেখস কি! আমাদের সময়ত… এইভাবেই বোধয় কিংবদন্তী তৈরি হয়! )। এখনো মনে আসে, শিক্ষকের নাম ঘোষণার পর, মনে হইল গায়ে ছেঙটা পরসে। আতঙ্ক টের পাইতেসিলাম, উত্তেজনাও ছিল অনেক। এর আগে ২–১টা workshop ছাড়া উনার বোধয় তেমন অভিজ্ঞতা ছিলনা, বয়সও ছিল খুব কম। সেই আনকোরা তরুণের উত্তেজনার ঝাঁজ পাইলাম আমরা। কি মাদকতার সেইসব দিন। ঘোরের মধ্যেই কাটত দিন রাইত। এর আগে পরে তারুণ্য বুঝিনাই কখনো। –ঘুম ভাংসে ছবি ভাইবা, ঘুমাইয়াও পড়ছি হয়ত ছবি বুকের তলে রাইখা। আর মাঝে দুঃস্বপ্ন হিসাবেত দাড়িওয়ালা ঐ মুখ আসতই। আমরা একজন আরেকজনের কাছ থিকা updated হইতাম কে কবে দুঃস্বপ্ন দেখসে। আরও পরে, সম্পর্ক গাড় হইলে ঋতু আপুর মুখ থেকে শুনছি দুঃস্বপ্ন শুধু আমরাই দেখিনাই, দেখতেন উনিও। আর ঘুমের মধ্যে ঋতু আপুকে শুনতে হইত ওইসব মধুবর্ষণ!
আরও পরে ২০১০ সালের আগস্টে যখন ছাত্রদের নিয়া প্রথম হাজির হইলেন, বোমা ফাটছিল মনে হয় পাঠশালায়। সেই বোমা’র প্রভাব কম বেশী এখনো দৃশ্যমান। কিন্তু যেইটা বলতে এই কথা, ঐ presentation শেষে যেই আবেগে উনি ভাসছেন, আমরা ভাসছি– ঐটাতেই বুঝি আমাদের সবটা দখলের অধিকার আসলে কই পাইসিলেন উনি।নিজের দেড়গুণ বেশী বয়সী ছাত্রের সমর্পণ পাইতেও বেশী বেগ পাইতে হয়নাই তার।
তার ছাত্রদের অনেকেই এখনো ভাষা খুঁজতেসে, কেউ কেউ নিজের ভাষার দখল বাড়াইতেসে– ভাষা খোঁজার অসম্ভব কঠিন আর নিঃস্বঙ্গ রাস্তায় এই লোকটারে পাশে পাইসে প্রতিদিন, কম আর বেশী। অথচ এই শিক্ষকের কোন ছাত্রই তার মত ছবি তোলেনা। একজন শিল্পীর জন্য শিক্ষক হওয়া কঠিন, নিজের ছায়ার বাইরে রাখা আরও কঠিন।এই অসম্ভব কাজটা সহজেই করসেন উনি।
মুনেম ওয়াসিফ, উনি আমার শিক্ষক। মায়ের পরে উনার কাছ থেকেই বোধয় সবচে বেশী শিখছি, ছবি নিয়া, জীবন নিয়াও। আমার থেকে সর্বচ্চ ২–৩ সনের বড় এই লোকটারে বহুদিন পর্যন্ত আমার দেবতাই লাগত। উনার বয়স বাড়ছে, আমিও বুড়া হইতেসি। উনি পিতা হইসেন, আমার দাঁড়ি পাকছে। দেবতা ভাবার বয়স এখন আর নাই। ভালয় মন্দে মেশানো একজন মানুষ–ই জানি এখন তারে। এইজন্যই বোধয় মোহ কাটসে, কিন্তু মুগ্ধতা আসে।
৭ বসর পার হইসে, এখন আমিও পড়াই, ঐ পাঠশালায়। আরও ৩ বসর আগে থেইকা। তার বিষয়টাই পড়াই। ভাষা আলাদা, মত–ও হয়ত মিল্বেনা অনেক সময়। কিন্তু এখনো যখন একটা ছবি নিয়া কথা বলি, নিজের সাথেই বাহাস হয়, ছায়া মুক্ত হইতে যুঝতে হয়। শিল্পী মুনেম ওয়াসিফের প্রভাব এড়াইতে পারসি হয়ত, শিক্ষক মুনেম ওয়াসিফের প্রভাব এড়ানো এখনো বহু দূরের রাস্তা, অন্তত আমার জন্য। ভিন্ন মত–ও যে শিখসি তার কাছ থেইকাই।
সেপ্টেম্বর, ২০১৬।